আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জনক কে? এই প্রশ্নের উত্তরের আমরা চোখ মুখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি আলবার্ট আইনস্টাইন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আপেক্ষিকতার সূচনা হয়েছিলো গ্যালিলিও গ্যালিলির হাত ধরে। গ্যালিলিও বলেছিলেন একটি সুষম গতিতে চলমান জাহাজের কেবিনে বসে আমরা স্থির আছি নাকি চলছি তা বোঝার কোনো সাধ্য নেই। অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন কেবিনে আবদ্ধ অবস্থায় আমরা যদি কোনো বস্তুকে মেঝেতে ছেড়ে দিই তাহলে সেটি পেছনে পড়ে গেলে বেঝা যাবে জাহাজ চলমান। কিন্তু এটিও ঠিক নয়, সুষম গতিতে চলমান অবস্থায় কেবিনে অবস্থানরত কোনো ব্যক্তি যদি উপর থেকে একটি বস্তুকে মেঝেতে ছেড়ে দেয় তবু এই স্থির অবস্থায় যেখানে পড়ার কথা সেখানেই পড়বে, কেননা এই বস্তুটিও জাহাজের সাথে সাথে চলমান। গ্যালিলীয় তার আপেক্ষিকতাকে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছেন: কোনো ব্যক্তি যদি তার পরিপার্শ্বের সাথে একই বেগে সুষমভাবে গতিশীল থাকেন তাহলে ব্যক্তির পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় তিনি স্থির নাকি গতিশীল আছেন। এই কারণেই পৃথিবী সূর্যের চারপাশে সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার বেগে অতিক্রম করা সত্ত্বেও আমরা বুঝতে পারি না যে আমরা গতিশীল আছি। কিন্তু এ-তো আবদ্ধ কেবিনের জন্য। কেমন হয় আমরা যদি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই? আমরা যদি দেখি যে বাইরের দৃশ্যপট সরে সরে যাচ্ছে তাহলেই তো বুঝতে পারব আমরা গতিশীল আছি। কিন্তু না, এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসবে আমরা গতিশীল, নাকি বাইরের দৃশ্যপট? নাকি উভয়েই আংশিকভাবে গতিশীল? আমাদের পক্ষে বোঝার উপায় নেই। আমরা কেবল বলতে পারব আমাদের উভয়ের মধ্যে গতির পার্থক্য কত বা কতটা ‘আপেক্ষিক গতিতে’ আমরা পরস্পরকে অতিক্রম করছি। আইনস্টাইন গ্যালিলিওর আপেক্ষিকতা নিয়েই চিন্তার সূচনা করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্বগুলো ‘ভেবে ভেবে’ আবিষ্কার করেছিলেন।
নিউটনের আপেল পতনের বিষয়টিকে সত্য ধরে নিয়েই চিন্তা করা যাক। নিউটন বলেছিলেন আপেল মাটিতে পতিত হয় কারণ এর উপর পৃথিবীর অভিকর্ষ (মাধ্যাকর্ষণ বল) প্রযুক্ত হয়। একটি বস্তুর উপর যদি কোনো বল প্রযুক্ত হয় তাহলে সেই বল বস্তুর ত্বরণের (বেগের পরিবর্তন) সৃষ্টি করে। কোনো বস্তু যদি সুষম বেগে চলতে থাকে তাহলে তার ত্বরণ থাকে না কিন্তু যদি তার বেগের পরিবর্তন ঘটে তাহলে আমরা বলতে পারি সেটি ত্বরিত হচ্ছে। যে কোনো বস্তুর উপর একটি নির্দিষ্ট স্থানে অভিকর্ষ বলের কারণে সুনির্দিষ্ট ত্বরণ ঘটে। পৃথিবী পৃষ্ঠে এই ত্বরণকে g দিয়ে সূচিত করা হয়। স্থুলভাবে এই মান ৯.৮ মিটার^২/সেকেন্ড। অর্থাৎ পৃথিবীতে পতনোন্মুখ কোনো বস্তুর বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৯.৮ মিটার করে বৃদ্ধি পেতে থাকবে ভূপৃষ্ঠে পতিত হওয়ার আগ পর্যন্ত।
কিন্তু আইনস্টাইন বললেন, না এই ধরণের কোনো অভিকর্ষ বলের অস্তিত্ব নেই। মানে, অস্তিত্ব থাকতে পারে কিন্তু আমরা এই্ ধরণের কোনো বলের অস্থিত্ব ছাড়াই, বিকল্প পদ্ধতিতে আপেলের পতনকে ব্যাখ্যা করতে পারি। আমরা বলতে পারি আপেলটি স্থির আছে আর পৃথিবী নিজেই তার যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে আপেলের দিকে ত্বরিত হচ্ছে। আমাদের পক্ষে কেবল আপেল আর পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করে বলা শক্ত কে কার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আইনস্টাইনের ভাবনা এই পরিস্থিতিতে কিঞ্চিৎ হাস্যকর শোনাতে পারে কিন্তু তার বিবৃতিতে যথাযথ যুক্তি ছিলো এবং এইভাবে ভাবতে ভাবতেই তিনি পরবর্তীতে সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সেটি কিভাবে, তা দেখা যাক।
কিন্তু আইনস্টাইন বললেন, না এই ধরণের কোনো অভিকর্ষ বলের অস্তিত্ব নেই। মানে, অস্তিত্ব থাকতে পারে কিন্তু আমরা এই্ ধরণের কোনো বলের অস্থিত্ব ছাড়াই, বিকল্প পদ্ধতিতে আপেলের পতনকে ব্যাখ্যা করতে পারি। আমরা বলতে পারি আপেলটি স্থির আছে আর পৃথিবী নিজেই তার যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে আপেলের দিকে ত্বরিত হচ্ছে। আমাদের পক্ষে কেবল আপেল আর পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করে বলা শক্ত কে কার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আইনস্টাইনের ভাবনা এই পরিস্থিতিতে কিঞ্চিৎ হাস্যকর শোনাতে পারে কিন্তু তার বিবৃতিতে যথাযথ যুক্তি ছিলো এবং এইভাবে ভাবতে ভাবতেই তিনি পরবর্তীতে সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সেটি কিভাবে, তা দেখা যাক।
মনে করি ভূ-পৃষ্ঠের উপর দিয়ে একটি ট্রেন ত্বরিত হচ্ছে, অর্থাৎ সময়ের সাথে এর গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। মনে করি ট্রেনের ভিতরে একজন মানুষ বসে আছেন। ট্রেনটি যদি ত্বরিত না হয়ে সুষম বেগে গতিশীল থাকত তাহলে সেই ব্যক্তি অনুভব করতেন না তিনি স্থির আছেন না গতিশীল, কিন্তু যেহেতু এটি ত্বরিত হচ্ছে সেই ব্যক্তি ট্রেনের পেছন দিকে একধরনের টান অনুভব করবেন। শুধু তিনিই নন তাঁর সাথে ট্রেনের ভেতরে যা কিছু অবস্থান করবে সবাই এই টান অনুভব করবে। এখন এই টানের সাথে অভিকর্ষের টানের পার্থক্য কোথায়? তেমন কোনো পার্থক্যই নেই বলা যায়, পার্থক্য শুধু দুটি বল দুই ভিন্ন দিকে অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু উভয় ধরের টানের প্রভাব বা ফলাফল একই ধরনের অনুভূত হবে। এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি, ট্রেনটি সামনের দিকে ত্বরিত হচ্ছে এটি বলা যেই কথা, এটি আমাদেরকে পেছন দিকে টানছে এই বলাও একই কথা। এই কথাটিই আইনস্টাইন পৃথিবীর ক্ষেত্রেও বলতে চেয়েছেন। এখন পৃথিবী পৃষ্ঠে একটি ত্বরিত ট্রেনের ক্ষেত্রে আমরা দুই ধরনের টান অনুভব করব। একটি টান ট্রেনের জন্য ট্রেনের পেছন দিকে, আরেকটি টান পৃথিবীর জন্য নীচের দিকে। এই দুই টানের সম্মিলিত প্রভাবে ট্রেনের ভেতরে আমরা কোণাকুনি বরাবর একটি সার্বিক টান অনুভব করব (নিচের চিত্র দ্রষ্টব্য)। এই টানটি ট্রেনে অবস্থিত প্রত্যেকটি বস্তুই অনুভব করবে। ফলে আমরা ট্রেনের ত্বরণ, পৃথিবীর অভিকর্ষ ইত্যাদি আলাদা আলাদা উল্লেখ না করে যদি বলি আমরা স্থির অবস্থায় আছি এবং একটি গ্রহ কোণাকুনি ভাবে আমাদের টানছে বা আমরা কোনো একটি গ্রহের পাহাড়ের ঢাল বরাবর স্থির অবস্থায় আছি তাহলেও পুরো বিষয়টি একই থাকবে। আমরা ট্রেন ভিতর থেকে আসলে বুঝতেই পারব না আসলে কী ঘটছে কিন্তু আমরা এভাবে ধরে নিলেও বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে কোনো অসুবিধা হয় না। আমরা উল্লম্ব (vertical) বলতে যা বুঝি, নতুন অবস্থায় সেই কোণাকুনি দিকটিকে উলম্ব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে বা উলম্ব দিকের মতোই আচরণ করবে।
আনুভুমিক ও উলম্ব দুই বলের প্রভাবে সৃষ্ট লব্ধি বল হবে কোণাকুণি বরাবর |
বাক্সটি যদি মহাশূন্যের আকর্ষনবিহীণ স্থানের মধ্য দিয়ে g ত্বরণে উপরের দিকে উঠতে থাকে তাহলে ভিতরের বস্তুগুলো যেমন অনুভব করবে, পৃথিবীপৃষ্ঠে স্থির অবস্থায় রাখলেও একই রকম অনুভব করবে। |
পৃথিবীতে পড়ন্ত বস্তুগুলো পড়তে পড়তে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে থাকবে। |
স্থান কালের বক্রতার গ্রাফ। ভারী বস্তুগুলো না থাকলে এই গ্রাফ সমতল হতো। |
মহাকর্ষ বলের মতোই স্থান-কালের বক্রতার পরিমাণ নির্ভর করবে ভরের উপর। কোনো বস্তুর ভর যত বেশী হবে তার চারপাশের স্থানকালের বক্রতাও তত বেশী হবে। এভাবে স্থান কালের বক্রতা থেকে একটি ভারী বস্তুর চারপাশে অপেক্ষাকৃত হালকা বস্তুর প্রদক্ষিণও ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। একজন পরিদর্শকের কাছে বস্তুটির গতি বৃত্তাকার মনে হতে পারে কিন্তু ওই স্থান-কালের ভিতরে সেই গতিটি সরলরৈখিক। স্থান-কাল নিজেই বৃত্তাকারে বেঁকে গেছে বলে বাহ্যিকভাবে গতিপথটিকে বৃত্তাকার বা বক্র মনে হয়।
নিচের ভিডিওর মাধ্যমে কিভাবে একটি বক্র স্থানকালের মধ্যে একটি বস্তু গতিপ্রাপ্ত হয় তা খুব স্থুল একটি তুলনার মাধ্যমে কিছুটা বোঝা যেতে পারে।
নিচের ভিডিওর মাধ্যমে কিভাবে একটি বক্র স্থানকালের মধ্যে একটি বস্তু গতিপ্রাপ্ত হয় তা খুব স্থুল একটি তুলনার মাধ্যমে কিছুটা বোঝা যেতে পারে।
তবে এখানে স্থানকালের গ্রাফের বিষয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। আমরা ছবিতে দেখানোর সময় স্থান-কালের যেই বক্রতা দেখাই সেটি ঠিক এভাবে বর্তমান থাকে না বা দৃষ্টিগোচর হয় না। এটি শুধুমাত্র একটি গ্রাফ। এর একটি অক্ষ বরাবর স্থান, এবং অপর অক্ষ বরাবর কাল বা সময় চিন্তা করে এই গ্রাফটি তৈরি করা হয়েছে। এই গ্রাফটি নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দিতে গেলে এই লেখাটি শেষ করা কঠিন হয়ে যাবে তাই আপাততঃ বেশি কিছু বলছি না। সাধারণ পাঠক আপাততঃ স্থানকালের গ্রাফটিকে একটি কাপড়ের সাথে তুলনা করতে পারেন উপরের ভিডিওটির মতো যাতে কোনো ভারী বস্তু রাখা হলে তা খানিকটা ডেবে যায় এবং তাতে কাপড়ে বক্রতা তৈরি হয়। কাপড়ের মাঝখানে যত ভারী বস্তু রাখা হবে সেটি তত বেশী ডেবে যাবে। এবং কোনো গতিশীল বস্তু এই ডেবে যাওয়া অংশের প্রভাবে একটা বাঁকা পথে পরিভ্রমন করবে।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন নিউটনের মহাকর্ষীয় বলের তত্ত্ব ত্যাগ করে আমাদের এই অপেক্ষা জটিল ‘ধরে নেওয়া’ এবং ভেবে ভেবে বের করা তত্ত্ব গ্রহণ করতে হবে। এর কারণ আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব মহাকর্ষ ছাড়াও আরো অনেক কিছু ব্যাখ্যা করে যা নিউটনীয় তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে না। এর মধ্যে রয়েছে কোন ভরযুক্ত বস্তুর পাশ দিয়ে আলোক রশ্মির বেঁকে যাওয়া তথা গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং (gravitational lensing), ভরযুক্ত বস্তুর কাছে সময়ের ধীর হয়ে যাওয়া বা কাল দীর্ঘায়ন (time dilation), র্ঘূণায়মান ভরের দিকে স্থান-কালের টান ইত্যাদি। আইনস্টাইন এই ঘটনাগুলো ভেবে ভেবেই বের করেছেন যদিও কিন্তু পরবর্তীতে বাস্তবিক ক্ষেত্রে এর সবগুলো পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে প্রমাণীত হয়েছে। কাজেই কোনো ভাবেই আইনস্টাইনের আপাত বিদঘুটে তত্ত্বটিকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। এই তত্ত্বটিতে তাঁর অনুমিত প্রায় সবকিছুই যথাযথ হিসেবে পাওয়া গিয়েছে। শুধু তাঁর অনুমিত একটি বিষয়ই দীর্ঘদিন ঝুলে ছিলো। সেটিই হচ্ছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ (gravitational wave বা G wave)।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ধারনা কিভাবে তৈরি হয়? আমরা স্থান-কালকে একটি কাপড়ের সাথে তুলনা করে নিয়েছি এবং দেখেছি যে একটি কাপড়ের উপর একটি ভারী বস্তুকে রাখা হলে তার আচরণ অনেকটা বাস্তব ক্ষেত্রে কোনো ভরযুক্ত বস্তুর আশাপাশে স্থান-কালের গ্রাফের আচরণের মতোই। আর কাপড়টি যেহেতু নমনীয় তাই এটিকে ভরের মাধ্যমে আন্দোলিত করা সম্ভব। যেমন: পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে এর পৃষ্ঠে আন্দোলন বা হিল্লোল তৈরি হয়। সেই আন্দোলন তরঙ্গাকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই না পানির উপর দিয়ে কোনো কিছু টেনে নিয়ে গেলেও সেটি তরঙ্গ তৈরি করতে করতে যায়। যেমন: একটি নৌকা যদি পানির উপর দিয়ে চলমান থাকে তাহলে দেখতে পাব সেটি পানিতে তরঙ্গ তৈরি করছে এবং তা ছড়িয়ে পড়ছে। নিচের চিত্রটি দেখুন:
নৌকার চলনে পানির পৃষ্ঠে উৎপন্ন হিল্লোল। |
এখন একটি বস্তু যখন স্থানকালের কাপড়ের মধ্যে বিশেষ ভাবে ত্বরিত থাকে তখন তার প্রভাবেও সেই স্থান-কালে সংকোচন-প্রসারণ তৈরি হতে পারে যা তৈরি করবে স্থান-কালের হিল্লোল বা ripple। তবে ঠিক সব বস্তু থেকে এই ধরনের হিল্লোল তৈরি হবে না। এই কাজের জন্য কোন এলাকার ভর বিন্যাসের কোয়াড্রুপল মোমেন্ট পরিবর্তন করতে হবে। এই কাঠখোট্টা টার্ম মনে রাখার বা বোঝার প্রয়োজন নেই্। আপাততঃ একটি অসমভাবে বিন্যাস্ত ভরের চিন্তা করুন। একটি সুষম গোলক বা সিলিন্ডারের ভর সুষম। কিন্তু যদি কোন এলাকায় ভর এভাবে সুযমভাবে বিন্যাস্ত না থাকে বরং এক পাশে কম একপাশে বেশী থাকে অর্থাৎ প্রতিসম না হয় তাহলে এধরনের হিল্লোল তৈরি হতে পারে (কাপড়ের ক্ষেত্রেও চিন্তা করে দেখুন না একটি অতি মসৃণ গোলক কাপড়ে সহজে ঢেউ বা ভাঁজ তৈরি করতে পারবে না।) কিন্তু যদি দুটি ভিন্ন ভরের বস্তু একে অপরের চারপাশে ঘুরতে থাকে বা যদি কোথাও ক্যাওটিক (chaotic) বিস্ফোরণ ঘটে তাহলে এই ধরনের মোমেন্টে পার্থক্য তৈরি হবে এবং স্থান-কালের হিল্লোল তৈরি হবে। আমাদের সূর্য আর পৃথিবী মিলেও এভাবে তরঙ্গ তৈরি করতে পারে, কিন্তু এই যুগলের উৎপন্ন তরঙ্গ এতোই দুর্বল হবে যা সনাক্তকরণ অচিন্ত্যনীয়।
এই যে তরঙ্গ তৈরি হলো এর গতি কেমন হবে? পানির ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই এই তরঙ্গ খুব ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়। তরঙ্গের গতি নির্ভর করে পৃষ্ঠ কতটা নমনীয় তার উপর। কাপড় যদি নমনীয় হয় তাহলে গতি ধীর হবে যাবে আর যদি দৃঢ় হতে থাকে তাহলে গতি ক্রমশঃ বাড়তে থাকবে। স্থান-কালের নমনীয়তা কেমন? যতটা হলে এর মধ্য দিয়ে গমনকারী তরঙ্গের গতি হয় আলোর গতির সমান! ঠিকই ধরেছেন। স্থান কালের মধ্য দিয়ে এই হিল্লোল তথা G-wave আলোর গতিতেই এগিয়ে যাবে। আলোর গতি কেন? বা অন্য ভাবে বললে কেন আলোই বা স্থানকালের মধ্য দিয়ে এই গতিতে চলে? আসলে স্থুলভাবে উত্তরটি দিয়েই দিয়েছি। স্থান কালের নমনীয়তা এর মধ্য দিয়ে কোন বস্তুর গমনের সর্বোচ্চ এই গতি নির্ধারণ করে দেয়। এটা আসলে বস্তুর গতি নয়, এটি হলো ঘটনার গতি বা কার্যকারণের (causality) গতি, এটি স্থান-কালের মধ্য দিয়ে কোনো কিছুর ফল প্রযুক্ত হওয়ার সর্বোচ্চ গতি। এই গতিতে স্থানকাল পরস্পরের সাথে কথা বলতে পারে বা যোগাযোগ রাখতে পারে। আর স্থান-কালের মধ্য দিয়ে কোনো কিছুর গতিকে চেপে ধরে ভর। এটি হচ্ছে অনেকটা ভীড়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো। ভরকে তুলনা করতে পারি জনপ্রিয়তার সাথে। আপনি যদি ভীড়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে যান তাহলে আপনি জনপ্রিয় হলে আপনার চারপাশে লোকজনের ভিড় পড়ে যাবে আর আপনার গতি বাধাপ্রাপ্ত হবে। যতবেশী জনপ্রিয় হবেন ততোই ভিড় বেশী হবে আর আপনার চলাচলেও বাধা পড়বে বেশী। কিন্তু আপনি অজনপ্রিয় হলে বা আপনার অস্তিত্ব সম্বন্ধে দুনিয়াদারী ওয়াকিবহাল না হলে ভীড় বাঁচিয়ে আপনার স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে চলে যেতে পারবেন। আলোর গতিই হচ্ছে শূন্য নিশ্চল ভর বিশিষ্ট যেকোনো কণিকা বা তরঙ্গের এই স্বাভাবিক তথা সর্বোচ্চ গতি যা সে স্থান-কালের মধ্য দিয়ে অর্জন করতে পারে। এই কারণেই আলোর চেয়ে বেশী গতিতে কোনো কিছু/ঘটনা/কার্যকারণ চলতে পারে না। মহাকর্ষীয় এই হিল্লোলের বা তরঙ্গও তাই আলোর গতিতেই তরঙ্গায়িত হবে।
(প্রচুর ছবি ও এনিমেশন যুক্ত হওয়ায় এবং লেখাটি বেশ বড় হওয়ায় দুই খন্ডে ভাগ করে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া হলো।)
(প্রচুর ছবি ও এনিমেশন যুক্ত হওয়ায় এবং লেখাটি বেশ বড় হওয়ায় দুই খন্ডে ভাগ করে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া হলো।)